হায়েজের (মাসিক) বিধান সমূহ বিস্তারিত

আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত করতে যেমন আদেশ করা হয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে নানান বিধি নিষেধ। আমরা চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো ইবাদাত করতে পারবো না। কারন কোনো কোনো সময় নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত করতে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি মাসিক বা হায়েজ চলাকালীন সময়। এটি আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মহিলাদের প্রাকৃতিক একটা সমস্যা। যাইহোক আমরা এখানে হায়েজের (মাসিক) বিধান সমূহ বিস্তারিত ভাবে তুলে ধররার চেষ্টা করবো :

ইসলামের দৃষ্টিতে হায়েজের (মাসিক) বিধান সমূহ

সাধারন বিধান

  • ১) মাসিক চলাকালীন সময়ে ফরয, নফল কোনো নামায পড়া জায়েয নয় এবং রোযা রাখাও জায়েয নয়। তবে মাসিক চলাকালীন সময়ে যত ওয়াক্ত নামায আসিবে, তত ওয়াক্ত নামায মাফ হয়ে যাবে আর যত রোযা আসিবে, তত রোযার কাযা আদায় করবে।
  • ২) একজন মেয়েলোকের ৪ দিন বা ৯ দিন মাসিক হওয়ার অভ্যাস ছিল। তাহলে অভ্যাস মোতাবেক মাসিক বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে তার উপর গোসল করা ফরয হবে।
  • ৩) আর গোসল করার পূর্বে সহবাস করা জায়েয হবে না। তবে কোনো  কারনে গোসল করতে না পেরে যদি এক  ওয়াক্ত চলে যায়, তাহলে তার জন্য সহবাস করা জায়েয হবে অন্যথায় নয়।
  • ৪) মাসিক চলাকালীন সময়ে স্ত্রী সহবাস করা হারাম। তবে স্বামীর বসা, উঠা, রান্না-বান্না করা এবং শয়না করা (চুম্বন , আলিঙ্গন) করা জায়েয। তবে, স্বামীর আত্মসংযম না থাকলে, এগুলো করাও জায়েয নয়। 

নামায এর ক্ষেত্রে

  • ৫) যদি কেহ কোনো ওয়াক্তের নামায পড়ে নি কিন্তু ওয়াক্তের নামায পড়ার সময় এখনো বাকি আছে। এমতাবস্থায় মাসিক শুরু হলে, তাহলে উক্ত ওয়াক্তের নামায মাফ হয়ে যাবে। 
  • ৬) এমনকি যদি ওয়াক্তের ফরয নামাযের মধ্যেও মাসিক আসে, তাহলে উক্ত নামায মাফ হয়ে যাবে। অর্থাৎ পাক হওয়ার পর, আর কাযা আদায় করতে হবে না। কিন্তু নফল বা সুন্নত নামায পড়া অবস্থায় যদি হায়েয আসে, তাহলে উক্ত নামায মাফ হবে না বরং পাক হওয়ার পর, তার কাযা আদায় করতে হবে।

রমদান মাস এর ক্ষেত্রে

  • ৭) আর, যদি রোযার মধ্যে মাসিক শুরু হয়, তাহলে তাকে এই রোযা কাযা আদায় করতে হবে,  যদি সামান্য সময় বাকি থাকতে মাসিক শুরু হয়, তবুও। আর, এইভাবে নফল রোযা রাখার বেলায়ও একই বিধান।
  • ৮) রমদান শরীফের দিনের বেলায় যদি হায়েযের রক্ত বন্ধ হয়, তবে সাথে সাথে গোসল করবে এবং নামাযের  ওয়াক্ত হলে নামায পড়বে। এবং যদিও এই দিনের রোযা তাহার হবে না তবুও অবশিষ্ট দিন কিছুই খাওয়া যাবে না বরং পানাহার না করে থাকা ওয়াজিব।
  • ৯) আর, যদি হায়েয ১০ দিনের কমে রাতে বন্ধ  হয় এবং এমন সময় বন্ধ হয় যে, গোসল করার সময় পায় না। তবে রোযা রাখা জায়েয নয় তবে দিনে রোযাদারের মত থাকবে এবং পরে কাযা আদায় করবে। 
  • ১০) আর, যদি গোসল করার সময় পায়, তবে তার জন্য রোযা রাখা ওয়াজিব হবে। 
  • ১১) আর, যদি পূর্ণ ১০ দিনে রাতে বন্ধ হয় এবং এমন সময় বন্ধ হয় যে, রাত শেষ হতে একবার আল্লাহু আকবার বলার সময় পায় না। তাহলে এমতাবস্থায়ও তার জন্য রোযা রাখা ওয়াজিব হবে।

মাসিক অভ্যাস থেকে কম-বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে

  • ১২) যদি কোনো মহিলার ৫ দিন মাসিক হওয়ার অভ্যাস থাকে। আর কোনো মাসে ৪ দিন মাসিক হয়ে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এমতাবস্থায় গোসল করে নিবে। তবে সহবাস করতে পারবে না বরং ৫ম দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কারন, ৫ম দিন পর্যন্ত রক্ত আসার সম্ভাবনা আছে।
  • ১৩) আর, ১০ দিন পুরা হয়ে বন্ধ হলে, গোসলের পূর্বে সহবাস করা জায়েয হবে।
  • ১৪) যদি কোনো মেয়ের ৩ দিন ঋতুস্রাব হওয়ার অভ্যাস ছিল কিন্তু হঠাৎ একমাসে তার ১ বা ২ দিন ঋতুস্রাব হয়ে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এমতাবস্থায় তার উপর গোসল করা ফরয নয় বরং অযু করে নামায পড়বে। কিন্তু সহবাস করতে পারবে না। তারপর, ১৫ দিন পাক থাকার আগে আবার ঋতুস্রাব হলে, বুঝতে হবে যে, এটা হায়েযের রক্ত ছিল।
  • ১৫) কোনো মহিলার ৩ দিন ঋতুস্রাব হওয়ার অভ্যাস ছিল। হঠাৎ কোনো মাসে ৩ দিন পূর্ণ হওয়ার পরও, ঋতুস্রাব বন্ধ হলো না। এমতাবস্থায় সে গোসল করবে না এবং নামাযও পড়বে না।  এভাবে যদি পূর্ণ ১০ দিনের আগে বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে মনে করতে হবে যে, নিয়মের পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং এইসব দিন হায়েযের মধ্যে গণ্য হবে আর উক্ত দিনের নামায পড়তে হবে না। আর যদি ১০ দিন পরও মাসিক হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে , মাসিক ৩ দিন ছিল । সুতরাং ১০ দিন পর গোসল করে নিবে এবং রক্ত বের হওয়া সত্তেও নামায পড়বে। আর ৭ দিনের নামায কাযা করবে।
  • ১৬) আর যদি কারোর পূর্ণ ১০ দিনে হায়েযের রক্ত বন্ধ হয় এবং এমন সময় রক্ত বন্ধ হয় যে, গোসল করার সময় নাই, মাত্র একবার ‘আল্লাহু আকবার‘ বলার সময় আছে, তবুও ঐ ওয়াক্তের কাযা আদায় করতে হবে।
  • ১৭) আর যদি পূর্ণ ১০ দিনের কমে হায়েযের রক্ত বন্ধ এবং এমন সময় বন্ধ হয় যে, নামাযের ওয়াক্ত প্রায় শেষ । এমতাবস্থায় যদি সে এমন সময় পায় যে, সাথে সাথে খুব তাড়াতাড়ি গোসল করে, নিয়ত করে নামাযে দাঁড়িয়ে শুধু আল্লাহু আকবার বলিয়া তাহরীমা বাধিতে পারে। তাহলে তাহার উপর ঐ ওয়াক্তের নামায পড়া ওয়াজিব এবং তা কাযা আদায় করবে। আর, যদি এমন সময় না পায়, তাহলে ঐ ওয়াক্তের নামায মাফ হয়ে যাবে।

বিবিধ

  • ১৮) ছিদ্রের (জরায়ু) বাহিরে যতক্ষণ পর্যন্ত রক্ত না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত হায়েয বা মাসিক ধরা যাবে না। অতএব, যদি কোনো মহিলা ছিদ্রের ভিতর রুই, তুলার গদ্দি রেকে রক্তকে ছিদ্রের মধ্যেই বন্ধ করে রাখে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না রক্ত বাহিরে আসবে বা গদ্দি বাহির না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত হায়েয ধরা যাবে না বা গণ্য করা যাবে না।
  • ১৯) আর, যখন রক্তের চিহ্ন বাহিরের চামড়া পর্যন্ত আসবে বা তুলা বাহির করবে, তখন হতে হায়েযের হিসাব শুরু হবে। 
  • ২০) আর, এভাবে যদি কোনো মহিলা এশার নামায পড়িয়া পাক অবস্থায়, ছিদ্রের ভিতর তুলার গদ্দি রেখে ঘুমাতে যায়। আর , সকালে ঘুম হতে উঠে তুলার মধ্যে রক্তের চিহ্ন দেখে, তাহলে যে সময় দেখবে, সেই সময় হতে হায়েয ধরা হবে। ঘুমের সময় হতে নয়।

মাসিক শুরুর কখন থেকে নামাজ পড়তে হবে না?

যখনই মাসিক শুরু হবে তখন থেকে মাসিক শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মধ্যবতী সময়ের সব ওয়াক্তের নামায মাফ অর্থাৎ নামায পড়তে হবে না। যদি কোনো ওয়াক্তের ফরয নামাযের মধ্যে হায়েয শুরু হয়, তবুও ঐ ফরয নামায আর পড়তে হবে না  অর্থাৎ এই ওয়াক্তের নামায মাফ। তবে সুন্নত বা নফল নামারত অবস্থায় মাসিক শুরু হলে, অবশ্য এইসব নামাযের কাযা আদায় করতে হবে। আর যদি  এমন হয় যে, কোনো মহিলা ওয়াক্তের নামায পড়ে নাই কিন্তু ওয়াক্তের সময় এখনও বাকি আছে। এমতাবস্থায় মাসিক শুরু হলে উক্ত ওয়াক্তের নামাযও মাফ হয়ে যাবে।

সর্বনিম্ন কতদিন মাসিক বন্ধ বা পবিত্র থাকা যায়?

দুই হায়েয বা মাসিকের মধ্যে পাক বা পবিত্র থাকার সর্বনিম্ন মুদ্দৎ বা সময় হলো ১৫ দিন। আর সর্বোচ্চ সময় নির্ধারিত নেই। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে যে, কোনো মহিলার কোনো কারণবশতঃ কয়েকমাস হায়েয বন্ধ থাকলে,  সে পবিত্র থাকবে।  অর্থাৎ যতক্ষণ না তার ঋতুস্রাব হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে পাক থাকবে। আরও বিস্তারিতভাবে বলা যায় যে, তাকে ঐ কয়েকমাস একাধারে নামায আদায় করে যেতে হবে। কোনো সময় এটা ভেবে নামায ত্যাগ করা যাবে না যে, ঐ মহিলার মাসের যে যে দিনে মাসিক হয়, সেইসব দিন বাদ দিয়ে বাকি দিন গুলোতে শুধু নামায আদায় করবে।

এক বা দুইদিন মাসিক হয়ে ১৫ দিন মাসিক বন্ধ থাকলে করণীয় কি?

  • যদি কোনো মহিলার এক বা দুই দিন মাসিক হয় এবং তারপর যদি ১৫ দিন মাসিক বন্ধ থাকে, তাহলে তার এই প্রথম দুই বা একদিনকে হায়েয বলা হবে না বরং এস্তেহাযা ধরা হবে। তাই সে এই সব কটি দিনই পাক থাকবে। কারন, প্রথমত তার দুই দিন মাসিক হয়েছে।  কেননা, তিন দিনের কম মাসিকের রক্তকে হায়েয বলা হয় না,  যা হাদিস দ্বারা নির্ধারিত। আর দ্বিতীয়ত তার যে ১৫ দিন রক্ত বন্ধ ছিল, তা তো পবিত্রতারই সময়। কেননা, পাক থাকার সর্বনিম্ন সময় হচ্ছে ১৫ দিন। সুতরাং, প্রথম দুই দিনের রক্তকে এস্তেহাযা ধরা হবে।
  • আর, যদি দুই বা একদিন মাসিক হয়ে বন্ধ হওয়ার পর, ১৫ দিনের আগে আবার শুরু হয় এবং একদিন বা দুইদিন পর বন্ধ হয়, তাহলে তা হায়েয ধরা হবে। এমতাবস্থায়, ঐ মহিলার আগে যতদিন মাসিক হওয়ার অভ্যাস ছিল, ঠিক ততদিন হিসাব করে, বাকি দিনগুলোকে এস্তেহাযা ধরবে। আর,যদি ১৫ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর, আবার দুই-এক মাসিক হয়। তাহলে এমতাবস্থায় তা হায়েয ধরা হবে না বরং এস্তেহাযা ধরা হবে।

        তথ্যসূত্রঃ- বেহেশতি জেওর, ১ম খন্ড।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!