রমজানে যা করনীয় ও বর্জনীয় – মাহমুদার কিছু উপদেশ

রামাদ্বান (রমজান) মাস আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের মাস। বলা যেতে পারে এই মাস আমাদের প্রাকটিসের মাস যাতে পরবর্তী ১১ মাস তদানুযায়ী কাটাতে পারি। তবে এই প্রাকটিসের জন্য আমাদের যেমন কিছু করনীয় রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে কিছু বর্জনীয়। আর তাই আমরা এখন জানবো রমজান মাসে আমাদের কি কি করতে হবে আর কি কি বর্জন কর্জন করতে হবে। চলুন কিছু জেনে নেই :

রমজানে যা করনীয় ও বর্জনীয়

  • (১) জিহবা, চোখ নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন গালি, গিবত, খারাপ কিছু না দেখা ইত্যাদি।
  • (২) কুরআন পড়ার জন্য সময় বের করা ও কিছুনা কিছু জানা। যেমন ওয়াজ শুনা, তাফসির জানা, হাদিস পড়া ইত্যাদি আর তার উপর আমল করার চেষ্টা করা।
  • (৩) ইফতারের আধা ঘন্টা আগে থেকে সব কাজ শেষ করে রাখা যাতে দুয়া, জিকির করা যায়।
  • (৪) ইফতারে অতি আয়োজন না করা, যাতে শরিরের জন্য কষ্ট হয় আবার ইবাদতের ক্ষতি হয়।
  • (৫) খালি পেটে ভাজা পোড়া খেলে গ্যাস হবে। এতে শরিরের ক্ষতি হবে আবার ইবাদত করা হবেনা ঠিক মতন, তাই শুরুতেই ভাজা পোড়া না খাই। ফল খাই, ভাত, রুটি, চিড়া ইত্যাদি খেতে পারি। এরপর ভাজা পুরা খেতে পারি, না খেলে আরও ভালো। পুরো পেঠ না ভরে একটু খালি রাখি। শুরুতেই এক গাদা পানি না খাই। এক গ্লাস শরবত বা পানি খেয়ে এরপর ভারি খাবার খেয়ে পানি বা শরবত খাই। কারন পেট সারাদিন খালি থাকে এরপর যখন আমরা প্রথমেই এক গাদা পানি খাই তখন শরির ছেড়ে দেয় দূর্বল হয়ে যায়।

আরও পড়ুন :

  1. মনি, মযি এবং অদি কি? মযি বা অদি বের হলে গোসল ফরজ হবে?
  2. সহবাসের পরই কি গোসল করা জরুরি? বিস্তারিত দেখুন
  3. মাসিকের (হায়েয) বিস্তারিত বিধানসমূহ জানুন এখান থেকে
  4. মাসিক চলাকালীন দোয়া-দুরুধ ও জিকির-আযকার করা যাবে?
  5. সাদা স্রাব বের হলে নামায হবে?
  • (৬) তারাবির পর পরই ঘুমানো উচিত যাতে তাহাজ্জুদ এ উঠা যায়। এক মাসের এই অভ্যাস পরে কাজে লাগবে সারা বছর তাহাজ্জুদ পড়তে।
  • (৭) খুব দ্রুত নামাজ, কুরআন ও জিকির না করি এতে উচ্চারণ ঠিক থাকেনা। কুরআন খতম বাধ্যতামূলক না তাই খতম করতে গিয়ে খুব দ্রুত না পরি। আমাদের সব আমলেই কিছুনা কিছু ভুল থাকতেই পারে তাই সব সময় যেকোন আমল (নামাজ, কুরান পড়া, জিকির শেষে) আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেয়া যদি ভুল হয়ে থাকে ইনশাল্লাহ মাফ পেয়ে যাব।
  • (৮) যেকোন আমল (নামাজ, কুরআন দুয়া জিকির ইত্যাদি) মন দিয়ে করা, হোক তা অল্প সময়। একি সাথে কাজ ও জিকির করলে মন দিয়ে জিকির করা হয়না তাই জিকির এর জন্য আলাদা সময় বের করে রাখা। আর অর্থ জেনে পড়লে আরও ভালো।
  • (৯) এশার পর নবি (সাঃ) কুরআন আর দুরুদ পড়তেন এবং ফজর ও আসরের পর আমল করতেন। আর ফজর এরপর কুরআন পড়লে বিশেষ ফজিলত আছে। তাই বুঝে শুনে আমল করুন।
  • (১০) মন থেকে মাফ চান আল্লাহর কাছে এতে মাফ পাওয়া হবে, দুয়া কবুল হবে। যত বার গুনাহ হবে ততবার মাফ চাবেন। যত বড় গুনাহ হোক আর যত বার হোক। keep trying. জান্নাত পেতে হলে আল্লাহর হক ঠিক রাখতে হবে কিন্তু জাহান্নাম থেকে বাচতে মানুষের হক ঠিক রাখতে হবে। তাই মানুষের হক (যেমন গিবত করা, খারাপ ব্যবহার করা, জমি দখল করা ইত্যাদি) নষ্ট করা থেজে বিরত থাকতে হবে। আপনি যেই পরিমান হক নষ্ট করবেন সেই পরিমান আমল দিয়ে দিতে হবে যার হক নষ্ট করলেন। আর আপনার আমলনামায় ভালো আমল না থাকলে যার হক নষ্ট করবেন যেই পরিমান করবেন সেই পরিমান তার গুনাহ আপনার ঘাড়ে আসবে। সুতরাং সাবধান!!

রেফারেন্স : আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি জান, দেউলিয়া কে? তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের মধ্যে দেউলিয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার দিরহামও (নগদ অর্থ) নেই, কোন সম্পদও নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে সেই ব্যক্তি হচ্ছে দেউলিয়া যে কিয়ামত দিবসে নামায, রোযা, যাকাতসহ বহু আমল নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সাথে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত (হত্যা) করেছে, কাউকে মারধর করেছে, ইত্যাদি অপরাধও নিয়ে আসবে। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল হতে এ ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে, ও ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ বদলা (বিনিময়) নেয়ার আগেই তার সৎ আমল নিঃশেষ হয়ে গেলে তাদের গুনাহসমূহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (হাদিস নং ২৪১৮ সূনানে আত তিরমিজি) আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ।

  • (১১) মানুষকে ইসলামের জন্য নসিহত করি কিন্তু তিরস্কার না। কারন আপনি যে হেদায়েতে আছেন তা আল্লাহর দয়ায় আর যে ভালো না তাকে সুন্দর করে দাওয়াত দেই। কারন যেখানে আজ যে অমুসলিম, কাল সে মুসলিম হতে পারে আল্লাহ চাইলে, সেখানে যে মুসলিম (হোক সে খারাপ মুসলিম) তাকে তো আরও ভালো ভাবে নসিহত করা উচিত। একটা কথা মনে রাখা উচিত হেদায়েত আল্লাহর হাতে তাই আপনাদের কাজ দাওয়াত দেয়া, বাকি আল্লাহর হাতে। কেও নসিহত না মানলে তর্ক না করে আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দেয়া, আর তিরস্কার গিবত না করা এতে আপনার সওয়াব না হয়ে গুনাহ হয়ে যেতে পারে। ভালো মুসলিম হতে সাহায্য করি, তিরস্কার না। আর কেউ যতই খারাপ বা ভালো হোক জাহান্নামি বা জান্নাতি tag না লাগাই। কারন এটি আল্লাহর হাতে এবং উনার ইচ্ছা। আপনার আমল কবুল হয়েছে কিনা তা আপনি জানেন না তাই আশা রাখবেন, গর্ব না। কে জানে যাকে খারাপ ভাবছেন তার কোন আমল আল্লাহর প্রিয় হয়ে গেছে আর তাকে কবুল করে নিয়েছে। তাই এসব থেকে দূরে থাকি।
  • (১২) অনেক সময় নামাজ রোজা রাখছি কিন্তু মনের রোগ এর খেয়াল করিনা মানে লোভ, ঘৃণা, হিংসা, রিয়া (অন্যকে দেখানোর জন্য আমল করা), অহংকার, অকৃতজ্ঞ হওয়া ইত্যাদি। তাই প্রতিদিন নিজের সমালোচনা করে রোগ বের করার চেষ্টা করা ও ঠিক করার চেষ্টা করা। অনেক সময় না চাইতেও রিয়া করে ফেলি তাই নিজের আমল যত কম পারি প্রকাশ না করা। কখনো হিংসা এসে যায় তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা। গিবত করতে মন চায় তখন ধৈর্য্য ধরা, চুপ থাকা।
  • (১৩) কৃতজ্ঞ ও ধৈর্য্য ধারন অনেক বড় গুণ আল্লাহর অনেক পছন্দের তা পালন চেষ্টা করা।
  • (১৪) আমল করতে যেন পারি, নিজের হেদায়াত এর জন্য বেশি দুয়া করা এবং তা সব সময় করা।
  • (১৫) আমলের পরিমান এর চেয়ে গুনগত মানের উপর খেয়াল রাখা উচিত। অল্প আমল নিয়মিত আল্লাহর কাছে প্রিয়।

রেফারেন্স : রাসুল (সা.) বলেছেন, أَحَبُّ الْاَعْمَالِ إِلَى اللهِ تَعَالٰى أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল তা-ই যা কোনো ব্যক্তি সর্বদা পালন করে থাকে, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।’ [সহিহ মুসলিম : ১৮৬৬]

  • (১৬) ইমান উঠা নামা করে তাই হাল ছেড়ে না দিয়ে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চেষ্টা করে যাওয়া।
  • (১৭) আমল এর সওয়াব নিয়তের উপর নির্ভর করে যেমন আল্লাহর রাস্তায় যে দান করে সে অনেক ভালো কাজ করে কিন্তু তার নিয়ত যদি এটা হয় মানুষ তাকে দানশিল বলবে তাহলে সওয়াব হবেনা বরং গুনাহ হবে, রিয়ার পর্যায়ে চলে যাবে। তাই নিয়ত ঠিক আছে কিনা বার বার খেয়াল রাখা।
  • (১৮) আমরা কেউ-ই পুরা গুনাহ মুক্ত না। যেমন কেউ গান গাই আবার কেউ গিবত করি আবার কেউ নামাজ পড়িনা কেউ নিজেকে বড় মনে করি। গুনাহ সবাই করি কিন্তু গুনাহের ধরণ ভিন্ন। তাই কাউকে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকি এবং নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করি।

রেফারেন্স : আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপী। আর উত্তম পাপী হলো সে ব্যক্তি যে (গুনাহ করে) তওবা্ করে। (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, দারিমী এবং মিশকাতুল মাসাবীহ- ২৩৪১)

হাদিসের মান : হাসান : তিরমিযী ২৪৯৯, ইবনু মাজাহ ৪২৫১, দারিমী ২৭৬৯, মুসতাদারাক লিল হাকিম ৭৬১৭, সহীহ আল জামি‘ ৪৫১৫, শু‘আবূল ঈমান ৬৭২৫। তবে হাকিম এবং শু‘আবূল ঈমান-এর সানাদটি দুর্বল।

  • (১৯) আল্লাহর কাছে ফলাফল না চেষ্টা দামি। যেমন নুহ (আঃ) উনার কাজ করে গেছেন দাওয়াত দিয়েছেন অনেক বছর কিন্তু মুসলিম কম-ই হয়েছে। এখানে চেষ্টা অনুযায়ী ফলাফল খুবই কম। কিন্তু আল্লাহর কাছে উনি মূল্যবান। আবার অনেক নবি আছেন যাদের কোন অনুসারী থাকবেনা তবুও আল্লাহর কাছে সেই সব নবি মূল্যবান কারন তাদের চেষ্টা। আপনিও আপনার সাধ্যমত চেষ্টা করে যান।
  • (২০) আমরা নিখুত হওয়ার জন্য চেষ্টা করব কিন্তু নিখুত কেউই হতে পারবনা। তাই যারা পারছেন না নিজেকে ঠিক রাখতে তারা হতাশ হবেন না আপনার কাজ চালিয়ে যাওয়া, গুনাহ থেকে বিরত থাকা বাকিটা আল্লাহর হাতে। আমরা কেউই নিজের আমলের গুনে না, আল্লাহর রহমতের উছিলায় জান্নাত যাব, তাই কেউ নিজেকে বড় ভাব্বেন না। আমল দিয়ে আল্লাহর খুশি করার চেষ্টা করছি মাত্র। আমাদের আমলে খুত থাকবে। আমল দিয়ে জান্নাত কিনা যাবেনা,যতই ভাল আমল করি তাই আল্লাহর রহমত লাগবে জান্নাত যেতে গেলে। এর মানে এই না আমল করবনা ও নিখুঁত এর চেষ্টা করবনা, আমাদের কাজ চেষ্টা করা। সবার জন্য শুভ কামনা।

রেফারেন্স : আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কাউকেই তার ‘আমল (‘ইবাদাত-বন্দেগী) মুক্তি দিতে পারবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনাকেও না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমাকেও নয়। অবশ্য যদি আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রহমত দিয়ে আমাকে ঢেকে নেন। তবুও তোমরা সঠিকভাবে ‘আমল করতে থাকবে ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে। সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতে কিছু ‘আমল করবে। সাবধান! তোমরা (‘ইবাদাতে) মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে। তাতে তোমরা তোমাদের মঞ্জীলে মাকসূদে পৌঁছে যাবে। (সহীহ : বুখারী ৬৪৬৩, মুসলিম ২৮১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!